থাইরয়েড নাকি ডিপ্রেশন?

ডা. তানজিনা হোসেন

MENTAL HEALTH

ইদানীং সারাক্ষণ অবসাদগ্রস্থ লাগে। লো মুড মনে হয়। কোন কিছু করতে মন চায় না। ক্লান্তি, আলস্য, অবসাদ, ঘুম ঘুম ভাব যেন লেগেই আছে। মনোযোগ রাখা যাচ্ছে না কোন কিছুতে। আমরা জানি, এগুলো ডিপ্রেশন বা বিষন্নতার লক্ষণ। তবে প্রায় একই রকম লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যেতে পারে কিছু শারিরীক রোগের ক্ষেত্রেও। বিশেষ করে হরমোনজনিত সমস্যায়। যেমন, থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতিতে এসব উপসর্গ প্রায় হুবহু মিলে যায়। তাই এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকেরা থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা করতে বলে থাকেন।

অবসাদ, ক্লান্তি, মনোযোগে ঘাটতি, খেতে ইচ্ছে না করা, সারাক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, লো মুড-এই সব উপসর্গ ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে যেমন হতে পারে, তেমনি হাইপোথাইরয়েডিজমেরও লক্ষণ।

থাইরয়েড আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থি। প্রজাপতির আকারের মতোই বেশ বড় গ্রন্থি এটি, থাকে আমাদের গলার ঠিক সামনে, কন্ঠনালীর ওপর। এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত থাইরয়েড হরমোনই আমাদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ, বিপাকক্রিয়া ও দৈনন্দিন শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। কোন কারণে এই হরমোনের ঘাটতি দেখা দিলে শরীরের প্রায় প্রতিটি কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্থ হয়। সেই সাথে দেখা দেয় মানসিক কিছু বিপর্যস্ততাও, যার কথা আগেই বলেছি। এর অনেকগুলোই মিলে যায় ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা রোগের সাথে। আসুন দেখে নিই কোন কোন উপসর্গগুলো ডিপ্রেশন ও থাইরয়েড হরমোন ঘাটতি বা হাইপোথাইরয়েডজিমে ‘কমন’ পড়ে যায়।

অবসাদ, ক্লান্তি, মনোযোগে ঘাটতি, খেতে ইচ্ছে না করা, সারাক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, লো মুড-এই সব উপসর্গ ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে যেমন হতে পারে, তেমনি হাইপোথাইরয়েডিজমেরও লক্ষণ। তবে থাইরয়েড সমস্যায় এর বাইরেও আরও কিছু লক্ষণ থাকে। যেমন, হৃদস্পন্দন বা পালস রেট কমে যাওয়া, শীত লাগা, শুষ্ক ত্বক, চুল পড়ে যাওয়া, ওজন বৃদ্ধি, মুখ বা পা ফোলা, অনিয়মিত মাসিক বা অতিরিক্ত মাসিক, বন্ধ্যত্ব, বার বার গর্ভপাত, গলায় গলগণ্ড বা ফোলা থাইরয়েড ইত্যাদি। এসব লক্ষণ থাকলে অবশ্যই থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত। পরিবারে কারও থাইরয়েড হরমোনের সমস্যার ইতিহাস থাকলে সেটাও বিবেচনায় আনতে হবে। আবার বিষণ্নতার এসব উপসর্গ কোনো হরমোনজনিত সমস্যা ছাড়া কেবল মানসিক সমস্যাতেও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের অন্যান্য উপসর্গগুলোও লক্ষ করুন। যেমন, ঘুম না হওয়া বা ঘুম ভেঙে যাওয়া, আত্মহত্যার চিন্তা, ওজন কমতে থাকা, নিজের প্রতি উদাসীন মনোভাব ইত্যাদি।

থাইরয়েডের কারণেই হোক বা এমনি অন্য কোনো কারণে, ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার উপসর্গগুলো দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অনেক সময় থাইরয়েড হরমোন ঘাটতির কারণে সমস্যা হয়ে থাকলে চিকিৎসার মাধ্যমেই উপসর্গগুলো অনেকটা কমে আসে। আবার কখনো কখনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্যেরও প্রয়োজন হয়। তাই বিষণ্নতার উপসর্গ দেখা দিলে অবহেলা না করে অবশ্যই চিকিৎসা নিন। অন্য যে কোন রোগের মত এটিও একটি রোগ এবং এর সমাধানও সম্ভব।

সাইবারবুলিং ও অনলাইনে হয়রানি

সোশ্যাল মিডিয়া বা ডিজিটাল স্পেসের অনেক ভালো দিক যেমন আছে, তেমনি সাইবারবুলিং এর অন্ধকার ছায়াও সেখানে ভয়ানক প্রভাব ফেলে। কিশোর-তরুণরাই সাইবারবুলিংয়ের শিকার বেশি হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ আইসিটি ডেভেলপমেন্টের এক জরিপে দেখা যায়, সাইবারবুলিং বা অনলাইনে হয়রানির ৮০ ভাগ ভুক্তভোগী নারী। অযাচিত মন্তব্য কিংবা বার্তা, বিভিন্ন ঘটনায় ভার্চুয়াল তর্কে জড়িয়ে পড়া, প্রাইভেসি ভঙ্গ করা ইত্যাদি প্রায়শই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার মানসিক উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যম যেন দিন শেষে আমাদের অনেকের জন্যই মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই এর সঠিক ব্যবহার আমাদের জানতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে আসক্তি থাকলে সেটি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা খুবই জরুরি। ২০১৮ সালের পেনিসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় জানা দেখা যায়, দিনে যতটা সময় আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটাই তার থেকে ৩০ মিনিট করে হ্রাস করলেই বিষন্নতা, উদ্ব্যেগ ইত্যাদি সমস্যা অনেকাংশে কাটিয়ে উঠা সম্ভব। সেক্ষেত্রে সহজ যে কয়টি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে-

১। দিনের কিছু নির্দিষ্ট সময় নিজের সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকুন। বন্ধুদের সাথে আড্ডায়, অফিসের কাজে, খেলাধূলার সময়, পরিবারের সাথে সময় কাটানোর সময় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। সম্ভব হলে মুঠোফোন কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখুন।

২। মুঠোফোন কিংবা যেকোন ডিভাইস নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া বন্ধ করুন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় ব্যয় করা থেকে বিরত থাকতে বই পড়ুন বা গান শুনুন। ঘুমের আগে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রলিং করলেও মানসিক চাপ বাড়তে পারে।

৩। সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি দূর করার আরেকটি উপায় হলো সকল ধরণের নোটিফিকেশন বন্ধ করে দেওয়া। এতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। কেননা তখন আর আপনি নোটিফিকেশনের আওয়াজ শুনেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছুটে যাবেন না, বরং আপনি এখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করবেন কিনা – সেই সিদ্ধান্তটি থাকবে আপনার হাতেই।

৪। নিজের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে আপনার সোশ্যাল মিডিয়াও রাখুন পরিচ্ছন্ন। অপরিচিত কাউকে সংযুক্ত করা থেকে বিরত থাকুন। অযাচিত পেইজ, গ্রুপ, পোস্ট যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন।

৫। চাইলে কিছুদিনের জন্য সকল ধরণের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ্লিকেশন মুঠোফোন থেকে ডিলিট করে দিন। একান্তই প্রয়োজন ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার থেকে সেসময় বিরত রাখুন। এ সময়টি আপনার জন্য ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ হিসেবে কাজ করবে।

অনেক সময় আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা আমরা নিজেরা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারি না। ঠিক কোন কারণে বিষণ্ণ কিংবা কোন কারণে উদ্বেগ হচ্ছে এগুলো নিজেরাই জানি না। তাই সামাজিক মাধ্যম হোক বা অন্য কোনো কারণে যদি আপনি মানসিক চাপে ভোগেন, তবে মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত অতি দ্রুত। মনের বন্ধুতে এসেও আপনি জানাতে পারেন আপনার মানসিক উদ্বেগের কথা, আমাদের কাউন্সেলরদের সাথে কথা বলে জেনে নিন আপনার মানসিক চাপের কারণ সত্যিই মানসিক চাপ কিনা। আপনার মনের কথা শুনতে মনের বন্ধু সবসময় আপনার পাশেই রয়েছে!

ডাঃ তানজিনা হোসেন গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ব্লগটি মনের বন্ধু এক্সপার্ট দ্বারা রিভিউয়ের পরে প্রকাশিত

এই ব্লগের একমাত্র উদ্দেশ্য মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে এতে কিছু প্রতীকি ঘটনা ব্যবহার করা হয়েছে।

এই ব্লগ বা এর কোনো অংশ পড়ে কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হলে তার জন্য লেখক ও ‘মনের বন্ধু’ দায়ী নয়। মনের ওপর চাপ অনুভব করলে বা মানসিকভাবে ট্রিগার্ড অনুভব করলে দ্রুত মনের বন্ধু বা যেকোনো মানসিক স্বাস্থ্যবিদের সাথে যোগাযোগ করুন।

মনের বন্ধুতে কাউন্সেলিং নিতে যোগাযোগ করুন: ০১৭৭৬৬৩২৩৪৪।

📍: ৮ম ও ৯ম তলা, ২/১৬, ব্লক-বি, লালমাটিয়া, ঢাকা

You might also like this

BLOG

কীভাবে সহমর্মী শ্রোতা হব?

আমরা অনেক সময় সামনে থাকা মানুষটির কথা থামিয়ে দিয়ে, তাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে যাই। এ অভ্যাসটিও একজন ...

BLOG

ক্লাস শুরু হওয়ার আগে কেন এত টেনশন?

যখনই ঘোষণা এলো ক্লাস শুরু হওয়ার, তখনই তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যেতে শুরু হলো। ভর্তি পরীক্ষার পর থেকে আর বই নিয়ে বসা হয়নি। তার উপর ...

BLOG

কেন আমরা কাজ ফেলে রাখি?

রুমের কোণায় পড়ে থাকা চেয়ারটিতে কাপড়ের স্তুপ জমে জমে ছোটোখাটো একটা এভারেস্ট হয়ে যাচ্ছে। অ্যাসাইনমেন্টের ডেডলাইন একদম চলেই এসেছে, তবু এখনো ...

BLOG

মেডিটেশন কি সত্যিই জরুরি?

“আরাম করে বসি। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করি। সমস্ত মনোযোগ নিয়ে আসি নাকের প্রতি। নাক দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নেই এবং ধীরে ধীরে ...