ডা: তানজিনা হোসেন
একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বড় পদে কাজ করেন ফাহমিদা (ছদ্মনাম)। ইদানীং অফিসে প্রায় সবার সাথেই তাঁর সমস্যা হচ্ছে। মন মেজাজ কেন যেন সব সময় খিটখিটে হয়ে থাকে। কোনো চাপ বা টেনশন নিতে পারছেন না আজকাল, সহজেই ভেঙে পড়ছেন বা অতি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন। কখনো অল্পতেই রেগে যাচ্ছেন, কখনো বিষন্ন হয়ে পড়ছেন বা মন খারাপ করছেন। এই বয়সে এসে এসব গোলমাল আর ভাল্লাগছে না। এর মধ্যে নতুন উপদ্রব হল হঠাৎ হঠাৎ গরম লাগে। ঘেমে নেয়ে সবার সামনে বিব্রত হয়ে পড়েন। মাথা কান গরম হয়ে ওঠে, ঝাঁ ঝাঁ করে। সব কিছু মিলিয়ে নিজের শরীর-মন নিয়ে বেশ নাজুক অবস্থায় পড়ে অবশেষে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হলেন তিনি। চিকিৎসক সব শুনে একটি প্রশ্ন করলেন, আপনার কি পিরিয়িড হচ্ছে, না বন্ধ হয়ে গেছে?
ফাহমিদার বয়স এখন আটচল্লিশ। খানিক চিন্তা করে তিনি বলেন, না হওয়ারই মত। দু এক মাস ঠিকমত হয়, তারপর আবার দু এক মাস বন্ধ। দু চারদিন থাকে। গত এক বছর ধরে এরকম চলছে। উত্তরে চিকিৎসক জানালেন, তার মানে আপনার পোস্ট মেনোপজাল সিম্পটমস হচ্ছে। সংক্ষেপে যাকে বলে পিএমএস (PMS)। এ সময় এরকমটা হয়েই থাকে। এটা খুবই স্বাভাবিক।
মেনোপজ যে কেবল আপনার মন ও মানসিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তাই নয়, এ সময় শরীরেও নানা ধরণের পরিবর্তন হতে থাকে।
নারীদের গোটা জীবন আসলে হরমোনের ওঠানামা দিয়ে ভীষণ প্রভাবিত। সেই কিশোরীকাল থেকে মধ্যবয়স অবধি, মাঝে প্রেগনেন্সি, সন্তান প্রসব, ব্রেস্ট ফিডিং -- নানা সময়ে, নানা রকমের হরমোনের ওঠানামা নারীর শরীর ও মনকে নানা ভাবে প্রভাবিত করতে থাকে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হল এই পিএমএস। মেনোপজ বা রজ:নিবৃত্তির স্বাভাবিক সময়কাল হল ৪৫ থেকে ৫৫ বছর। কারও একটু আগে হয়, কারও একটু পরে। তবে পিরিয়ড বা মাসিক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবার আগে প্রায় এক বছর মাসিক অনিয়মিত হওয়ার পাশাপাশি নানা রকম শারিরীক ও মানসিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হল ‘হট ফ্লাশ’। হঠাৎ মুখ কান মাথা গরম হয়ে ওঠা, লাল হয়ে ওঠা, ঘেমে যাওয়া, শরির জ্বালা করা এবং কিছুক্ষণ পর আবার ঠিক হয়ে যাওয়া- একেই বলে হট ফ্লাশ। এটি খুবই বিব্রতকর ও কষ্টদায়ক একটা অনুভূতি। এর বাইরেো আরো আট রকমের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে এ সময়। এগুলো হল-১. বিষন্নতা, ২. অ্যাংজাাইটি বা উদ্বেগ, ৩. মুড সুইং, ৪. উদ্যোগের অভাব, ৫. অবসাদ, ৬. মনোযোগে ঘাটতি, ৭. এগ্রেসিভ আচরণ এবং ৮. যৌন অনীহা।
কেন হয় এসব? ঐ যে বললাম, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা। মেনোপজের সময় মেয়েলি হরমোন ইস্ট্রোজেন এর মাত্রা দ্রুত পড়ে যেতে থাকে। এই ইস্ট্রোজেন ঘাটতিই মূলত এই সব উপসর্গের জন্য দায়ী। কোন কারণে যদি অপেক্ষাকৃত কম বয়সে মেনোপজ হয়, যেমন জরায়ু বা ওভারিতে সার্জারির কারণে, বা কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি নেবার কারণে, তবে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়। সবারই যে একই রকম উপসর্গ হবে তা নয়। কারও বেশি হতে পারে, কারও কম।
এখন তাহলে জানা যাক এই সময় মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে, আবেগ ও রাগ নিয়ন্ত্রণে কী করবেন? মনে রাখবেন, মেনোপজ যে কেবল আপনার মন ও মানসিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তাই নয়, এ সময় শরীরেও নানা ধরণের পরিবর্তন হতে থাকে। যেমন ওজন বৃদ্ধি, রক্তে ক্ষতিকর চর্বি বেড়ে যাওয়া, হৃদরোগের ঝুকিঁ বাড়া, অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয়, ফিটনেস কমে যেতে থাকা ইত্যাদি। তাই এ সময় শরীর ও মন- দুটোরই যত্ন নেয়া খুবই জরুরি। চলুন জেনে নেই কীভাবে এ সময় আপনি নিজের যত্ন নিতে পারেনঃ
১। আদর্শ ওজন বজায় রাখার চেষ্টা করুন। মেনোপজের সময় হঠাৎ মুটিয়ে যেতে থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই ওজনের রাশ টানতে হবে। নয়তো ফিটনেস যাবে কমে।
২। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার, তেল মসলাযুক্ত খাবার, ফাস্ট ফুড, রিচ ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার, বেশি চা কফি পান হট ফ্লাশের প্রবণতা বাড়ায়। তাই এগুলো এড়িয়ে চলুন। বরং প্রচুর তাজা ফল, তাজা শাক সবজি খান। একটা ফুড ডায়েরি তৈরি করতে পারেন। কবে হট ফ্লাশ ও খিটখিটে ভাব বেশি হয়েছে সেই তারিখ লিখে সেদিন কী কী খেয়েছেন তা স্মরণ করুন। তাহলেই ট্রিগার ফুডগুলোর তালিকা পেয়ে যাবেন। আর হ্যাঁ, প্রচুর পানি পান করবেন কারণ এ সময় ত্বক খুব শুষ্ক হয়ে পড়তে থাকে। আর খাবেন ভাল মানের প্রোটিন।
৩। এ সময় হাড় দুর্বল হতে থাকে। তাই ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার যেমন দুধ, টক দই ইত্যাদি বেশি খেতে হবে। ভিটামিন ডি পেতে প্রতিদিন সূর্যের আলো গায়ে মাখতে হবে ১৫ থেকে ২০ মিনিট।
৪। নিয়মিত হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন। গবেষণায় প্রমাণিত যে দৈনিক ২০-৩০ মিনিট হাঁটা, জগিং বা যে কোন ধরণের ব্যায়াম মেনোপজের সব উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে। যোগব্যায়াম, মেডিটেশন বা তাই চি আরও বেশি কার্যকর।
৫। রাতে ৭-৮ ঘন্টা ভাল ঘুম চাই। যত কাজই থাকুক, ঘুমের সাথে কম্প্রোমাইজ করবেন না।
৬। আমরা অনেক সময় ব্রেকফাস্টে বেশি খেয়েছি বলে লাঞ্চ এড়িয়ে যাই বা সকালে ঘুম থেকে দেরিতে ওঠায় ব্রেকফাস্ট করি না। এটি ক্ষতিকর অভ্যাস। প্রতি বেলায়ই নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। বিশেষ করে সকালের ব্রেকফাস্ট। খাবারের ক্ষেত্রে রুটিন মেনে চলুন তা যত ব্যস্ততাই থাকুক। গ্লুকোজের ওঠানামা আপনার মন মেজাজের ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
৭। কিছু খাবারে ফাইটোইস্ট্রোজেন নামক প্রাকৃতিক উপাদান থাকে যা মেনোপজের উপসর্গগুলো কমাতে সহায়ক। যেমন- সয়া প্রোটিন, টফু, তিলের বীজ, তিসি, কালোজিরা ইত্যাদি।
৮। নিয়ম মেনে চলার পরও যদি পিএমএস আপনার স্বাভাবিক জীবন ব্যহত করছে বলে মনে হয়, তবে চিকিটস্কের সহায়তা নিতে দেরি করবেন না। হট ফ্লাশ কমানোর জন্য ওষুধ রয়েছে। মানসিক সমস্যা আর উপসর্গগুলোর জন্য্ও আছে নির্দিষ্ট ওষুধ, চিকিৎসা, কগনিটিভি বিহেভিয়ার থেরাপি ও অন্যান্য থেরাপি। মনে রাখবেন এটি আপনার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিশনাল পিরিয়ড। এই সময় নিজের যত্ন নেয়া খুবই দরকার। দরকার নিজের শরীর ও মনের প্রতি বিশেষ নজরদারি।
ডাঃ তানজিনা হোসেন গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
ব্লগটি মনের বন্ধু এক্সপার্ট দ্বারা রিভিউয়ের পরে প্রকাশিতএই ব্লগের একমাত্র উদ্দেশ্য মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে এতে কিছু প্রতীকি ঘটনা ব্যবহার করা হয়েছে।
এই ব্লগ বা এর কোনো অংশ পড়ে কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হলে তার জন্য লেখক ও ‘মনের বন্ধু’ দায়ী নয়। মনের ওপর চাপ অনুভব করলে বা মানসিকভাবে ট্রিগার্ড অনুভব করলে দ্রুত মনের বন্ধু বা যেকোনো মানসিক স্বাস্থ্যবিদের সাথে যোগাযোগ করুন।
মনের বন্ধুতে কাউন্সেলিং নিতে যোগাযোগ করুন: ০১৭৭৬৬৩২৩৪৪।
📍: ৮ম ও ৯ম তলা, ২/১৬, ব্লক-বি, লালমাটিয়া, ঢাকা
Mental stress is our emotional and psychological response when we feel overwhelmed, pressured, or threatened by challenging situations.
ঘটনা ১ঃ দীর্ঘদিন সেমিস্টার ব্রেকের পর আবার ক্লাস শুরু হবে শায়লার (ছদ্মনাম)। ছুটিটা বেশ আনন্দেই কাটিয়েছে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো ছুটির শেষ দিকে এসে। এক প্রবল অস্থিরতা পেয়ে বসলো তাকে। বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লা
সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে সময়ের সাথে তাল মেলাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের হার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক,ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক, টেলিগ্রাম ইত্যাদি
আমরা মানুষ হিসেবে যে সমাজে বসবাস করি, সেটা মূলত নির্ভর করে পারস্পরিক সম্পর্ক, দায়িত্ব ও কর্তব্যের ওপর। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সমাজে দুই ধরনের মানুষ আছে। এক. যারা অন্যের জন্য কাজ করেন। দুই. যারা অন্যে